শির্কের প্রকার
শিরক
হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা।পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর
গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা। পড়ুনঃ সবচেয়ে বড় গুনাহ।
শির্কের
রয়েছে নানা ধরন ও প্রকরণ।নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলঃ
শির্কের
প্রথম প্রকার :
আল্লাহর
সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই ফেরেশতা বা নবীদের উদ্দেশে ইবাদত করা। যে তাদের ইবাদত করবে
সে আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী করবে এবং নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্তকারী হিসেবে
গন্য হবে। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّۧنَ أَرۡبَابًاۗ أَيَأۡمُرُكُم بِٱلۡكُفۡرِ بَعۡدَ إِذۡ أَنتُم مُّسۡلِمُونَ ٨٠ ﴾ [ال عمران: ٨٠]
‘আর তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীদেরকে রব রূপে গ্রহণ কর। তোমরা মুসলিম হওয়ার পর তিনি
কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবেন’? {সূরা আলে
ইমরান, আয়াত : ৮০}
দ্বিতীয়
প্রকার :
আল্লাহর
সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই ওলী-বুযুর্গানের উদ্দেশে ইবাদত করা। যে তাদের ইবাদত করবে সে
নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ বলেন,
﴿ ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٣١ ﴾ [التوبة: ٣١]
‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগী বুযুর্গদের রব হিসেবে
গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট
হয়েছে, তিনি ছাড়া কোনো (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে
তিনি তা থেকে পবিত্র’। {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩১}
﴿ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢٣]
‘আর তারা বলে, ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না; বর্জন
করো না ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ,
ইয়া‘ঊক ও নাসরকে’। {সূরা নূহ, আয়াত : ২৩}
ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও
নাসর- এদের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন পুণ্যবান মানব ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। আল্লাহর
সন্তুষ্টির সঙ্গে তারা এসব ব্যক্তির সন্তুষ্টিও খুঁজত ইবাদতে। তাই বুযুর্গকে খুশী
করতে কোনো ইবাদতের অবকাশ নেই।
তৃতীয় প্রকার :
আল্লাহর সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই বৃক্ষরাজি
বা ইট-পাথরের উদ্দেশে ইবাদত তথা ভক্তি নিবেদন করা। যে এসবের উদ্দেশে ভক্তি নিবেদন
করবে সে নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ বলেন,
﴿ أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ ﴾ [النجم: ١٩، ٢٠]
‘তোমরা লাত ও ‘উয্যা সম্পর্কে আমাকে বল’? আর মানাত সম্পর্কে,
যা তৃতীয় আরেকটি?’ {সূরা আন-নাজম, আয়াত : ১৯-২০}
চতুর্থ প্রকার :
শয়তানের উদ্দেশে ইবাদত তথা ভক্তি নিবেদন
করা। আল্লাহ বলেন,
﴿ ۞أَلَمۡ أَعۡهَدۡ إِلَيۡكُمۡ يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ أَن لَّا تَعۡبُدُواْ ٱلشَّيۡطَٰنَۖ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٦٠ وَأَنِ ٱعۡبُدُونِيۚ هَٰذَا صِرَٰطٞ مُّسۡتَقِيمٞ ٦١ ﴾ [يس: ٦٠، ٦١]
‘হে বনী আদম,
আমি কি তোমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, ‘তোমরা শয়তানের উপাসনা করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর আমারই ইবাদাত কর। এটিই সরল পথ’। {সূরা ইয়াসীন, আয়াত : ৬০-৬১}
এককথায় রহমান আল্লাহ ছাড়া যার উদ্দেশেই
ভক্তি-ইবাদত নিবেদন করা হবে তা শয়তানের জন্য বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ
করেন,
﴿ إِن يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ إِنَٰثٗا وَإِن يَدۡعُونَ إِلَّا شَيۡطَٰنٗا مَّرِيدٗا ١١٧ لَّعَنَهُ ٱللَّهُۘ وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنۡ عِبَادِكَ نَصِيبٗا مَّفۡرُوضٗا ١١٨ ﴾ [النساء: ١١٧، ١١٨]
‘আল্লাহ ছাড়া তারা শুধু নারীমূর্তিকে
ডাকে এবং কেবল অবাধ্য শয়তানকে ডাকে।
আল্লাহ তাকে লা‘নত করেছেন এবং সে বলেছে, ‘অবশ্যই
আমি তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে (অনুসারী হিসেবে) গ্রহণ করব’। {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১১৭-১১৮}
আবূ তোফায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَمَّا فَتْحَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ مَكَّةَ بَعَثَ خَالِدَ بْنَ الْوَلِيدِ إِلَى نَخْلَةٍ، وَكَانَتْ
بِهَا الْعُزَّى، فَأَتَاهَا خَالِدٌ , وَكَانَتْ عَلَى ثَلَاثِ سَمُرَاتٍ، فَقَطَعَ
السَّمُرَاتِ، وَهَدَمَ الْبَيْتَ الَّذِي كَانَ عَلَيْهَا، ثُمَّ أَتَى
النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرَهُ، فَقَالَ:
«ارْجِعْ فَإِنَّكَ لَمْ
تَصْنَعْ شَيْئًا» , فَرَجَعَ خَالِدٌ، فَلَمَّا بَصُرَتْ بِهِ السَّدَنَةُ
وَهُمْ حَجَبَتُهَا، أَمْعَنُوا فِي الْجَبَلِ ,
وَهُمْ يَقُولُونَ:
يَا عُزَّى يَا عُزَّى، فَأَتَاهَا
خَالِدٌ , فَإِذَا امْرَأَةٌ عُرْيَانَةٌ ,
نَاشِرَةٌ شَعْرَهَا ,
تَحْتَفِنُ التُّرَابَ عَلَى
رَأْسِهَا، فَعَمَّمَهَا بِالسَّيْفِ حَتَّى قَتَلَهَا، ثُمَّ رَجَعَ إِلَى
النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرَهُ ,
فَقَالَ:
«تِلْكَ الْعُزَّى»
মক্কা বিজয়ের পর
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালেদ ইবন ওলীদ (রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু)-কে নাখলাহ নামক স্থানে পাঠালেন। সেখানে উজ্জা নামের মূর্তি ছিল। খালেদ (রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু) সেখানে গেলেন। সেটি ছিল তিনটি গাছের উপর স্থাপিত। তিনি গাছগুলো কেটে ফেললেন
এবং তার ওপরের ঘর ভেঙ্গে দিলেন। পরবর্তীতে
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন এবং এ
ব্যাপারটি অবহিত করলেন। তিনি বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে দেখ, কোনো কাজই করোনি তুমি।
তখন খালেদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সেখানে পুনরায় গেলেন। খালেদ ফিরে গেলেন। তাকে দেখে
(ওই আশ্রমের) প্রহরীরা, হে উজ্জা হে উজ্জা বলে পাহাড়ের আড়ালে পলায়ন করল। খালেদ তার
সামনে পৌঁছামাত্র এক চুল খোলা উলঙ্গ নারীকে দেখলেন সে নিজের মাথায় মাটি নিক্ষেপ
করছে। তিনি তাকে তরবারি
দিয়ে আঘাত করে হত্যা করলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে বৃত্তান্ত তুলে ধরলেন। শুনে
তিনি বললেন, সে ছিল উজ্জা। [নাসায়ী, সুনান আল-কুবরা : ১১৪৮৩]
আর যে শয়তানের অনুসরণ-ইবাদত করে, শয়তান
তাকে রহমান আল্লাহর সঙ্গে শির্ক, কুফর ও বিদআত শেখায়। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا تَأۡكُلُواْ مِمَّا لَمۡ يُذۡكَرِ ٱسۡمُ ٱللَّهِ عَلَيۡهِ وَإِنَّهُۥ لَفِسۡقٞۗ وَإِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰٓ أَوۡلِيَآئِهِمۡ لِيُجَٰدِلُوكُمۡۖ وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ ١٢١ ﴾ [الانعام: ١٢١]
‘আর তোমরা তা থেকে আহার করো
না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয়
তা সীমালঙ্ঘন এবং শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর,
তবে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক’। {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১২১}
শয়তান মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্বর ও
সুরতে এবং স্বরূপে ও ভিন্নরূপে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَٱسۡتَفۡزِزۡ مَنِ ٱسۡتَطَعۡتَ مِنۡهُم بِصَوۡتِكَ وَأَجۡلِبۡ عَلَيۡهِم بِخَيۡلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكۡهُمۡ فِي ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَوۡلَٰدِ وَعِدۡهُمۡۚ وَمَا يَعِدُهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ إِلَّا غُرُورًا ٦٤ ﴾ [الاسراء: ٦٤]
‘তোমার কণ্ঠ দিয়ে তাদের
মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর, তাদের উপর ঝাপিয়ে পড় তোমার অশ্বারোহী
ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে অংশীদার হও এবং তাদেরকে
ওয়াদা দাও’। আর শয়তান প্রতারণা ছাড়া তাদেরকে কোনো ওয়াদাই
দেয় না’।
{সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৬৪}
আবূ তোফায়ল থেকে বর্ণিত
হয়েছে যে জাহেলী যুগের দেবী উজ্জার সম্মুখে শয়তান আত্মপ্রকাশ করেছিল। তখন খালেদ
ইবন ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে হত্যা করে ফেলেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে বৃত্তান্ত তুলে ধরলে তিনি বললেন, সে ছিল
উজ্জা। [নাসায়ী : প্রাগুক্ত]
ইমাম বুখারী দীর্ঘ এক হাদীসে ঘটনা তুলে
ধরেন যে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে শয়তান এসেছিল এবং তিন রাত অবস্থান
করেছিল। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
تَعْلَمُ
مَنْ تُخَاطِبُ مُنْذُ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ»، قَالَ: لاَ،
قَالَ:
«ذَاكَ شَيْطَانٌ»
‘তুমি কি জানো তিন রাত
তুমি কার সঙ্গে কথা বলেছ হে আবূ হুরায়রা? তিনি বললেন, জী না। নবীজী বললেন, সে ছিল
শয়তান’। [বুখারী : ২৩১১]
মোটকথা, শয়তান তার কণ্ঠ ও কর্ম দিয়ে মুশরিকদের বিভ্রান্ত
করেছে। অথচ তারা ভেবেছে এ বুঝি কেবল একটি চিত্র বা কবরস্থ কেউ। কিয়ামত পর্যন্তই সে
এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে যাবে। আমাদের কর্তব্য হবে, সর্বদা
শয়তানের চক্রান্ত ও প্ররোচনা সম্পর্কে সতর্ক থাকা। আল্লাহর কাছে দিবারাত্র শয়তানের
কুমন্ত্রণা ও কূটচাল থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের
শির্ক থেকে দূরে থাকার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে শির্কমুক্ত ঈমান নিয়ে কবরের
যাত্রী বানান। আমীন।
কৃতজ্ঞতাঃ islamhouse