মুনাফিকদের চরিত্র


দ্বিমুখী নীতি ও সিদ্ধান্ত হীনতা:
মুনাফিকরা দ্বৈতনীতির হয়ে থাকে। তাদের বাহ্যিক এক রকম আবার ভিতর আরেক রকম। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলে তখন তারা যেন পাক্কা ঈমানদার, আবার যখন কাফেরদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা কাট্টা কাফের। তাদের এ দ্বি-মুখী নীতির কারণে তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। সবার কাছেই তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে বলেন, " তারা এর মধ্যে দোদুল্যমান, না এদের দিকে আর না ওদের দিকে। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনো তার জন্য কোন পথ পাবে না।" -[সূরা নিসা: ১৪৩]


মুনাফিকরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। তারা সঠিকভাবে কোন কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তারা বুঝে শুনে মুমিনদের সাথেও নয় আবার না বুঝে কাফেরদের সাথেও নয়। বরং তারা উভয়ের মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। -[জামে’উল বায়ান ৯/৩৩৩]


মিথ্যা শপথ করা, কাপুরুষতা ও ভীরুতা:
মুনাফিকরা অধিক হারে মিথ্যা শপথ করে। তাদের যখন কোন অপকর্মের জন্য জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তারা তা সাথে সাথে অস্বীকার করে এবং তারা তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা শপথ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর তারা আল্লাহর কসম করে যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তারা এমন কওম যারা ভীত হয়। যদি তারা কোন আশ্রয়স্থল, বা কোন গুহা অথবা লুকিয়ে থাকার কোন প্রবেশস্থল পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত।[তওবা: ৫৬, ৫৭]

মুমিনদের মাঝে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা:
মুনাফিকরা চেষ্টা করে কিভাবে মুমিনদের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করা যায়। তারা সব সময় মুমিনদের মাঝে অনৈক্য, মত বিরোধ ও ইখতেলাফ লাগিয়ে রাখে। তারা একজনের কথা আরেক জনের নিকট গিয়ে বলে। চোগলখোরি করে বেড়ায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী, আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত।" [সূরা তওবা: ৪৭]

গাইরুল্লাহর নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়া:
মুনাফিকদের অন্যতম স্বভাব হল, তারা বিচার ফায়সালার জন্য আল্লাহর রাসূল সা. এর নিকট যেত না। তারা তাদের কাফের বন্ধুদের নিকট বিচার ফায়সালার জন্য যেত। যাতে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষম হয়। কারণ, তারা জানতো যদি ন্যায় বিচার করা হয়, তখন ফায়সালা তাদের বিপক্ষে যাবে। আর রাসূল সা. কখনোই ন্যায় বিচার ও ইনসাফের বাহির যেতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর, যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আস যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে।" [সূরা নিসা: ৬০, ৬১]

মুমিনদের ধোঁকা দেয়া:
মুনাফিকরা মনে করে তারা আল্লাহ তা‘আলা ও মুমিনদের ধোঁকা দিয়ে থাকে, প্রকৃত পক্ষে তারা কাউকেই ধোঁকা দেয় না। তারা নিজেরাই তাদের নিজেদের ধোঁকা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে (বলে মনে করে) অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।" [সূরা বাকারাহ: ৯] 
মুনাফিকরা তাদের রব ও মুমিনদের ধোঁকা দিত।তারা তাদের মুখে প্রকাশ করত যে, আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি, কিন্তু তাদের অন্তরে তারা অবিশ্বাস, অস্বীকার ও সন্দেহ-সংশয়কে গোপন করত, যাতে তারা তাদের জন্য অবধারিত শাস্তি- হত্যা, বন্দি করা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান ইত্যাদি হতে মুক্তি পায়। তারা মুখের ঈমান ও স্বীকার করাকে নিজেদের বাঁচার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। অন্যথায় তাদের উপর ঐ শাস্তি বর্তাত যা অস্বীকারকারী কাফেরদের উপর বর্তায়। আর এটাই হল, মুমিনদের ও তাদের রবকে ধোঁকা দেয়া। [ জামে’উল বায়ান ১/২৭২]

তারা মুমিনদের পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকে: 
মুনাফিকরা সব সময় পিছনে থাকত, কারণ, তারা অপেক্ষা করত, যদি বিজয় মুমিনদের হয়, তাহলে তারা মুমিনদের সাথে মিলে যায় আর যদি বিজয় কাফেরদের হয়, তখন কাফিরদের পক্ষে চলে যায়। তাদের এ ধরনের অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, " যারা তোমাদের ব্যাপারে (অকল্যাণের) অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করিনি’? সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না।" [সূরা নিসা: ১৪১]

কাফেরদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব: 
মুনাফিকরা কাফেরদেরকে তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। মুমিনদের তারা কখনোই তাদের বন্ধু বানাত না। তারা মনে করত কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করলে তারা ইজ্জত সম্মানের অধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, নিশ্চয় তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। যারা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান চায়? অথচ যাবতীয় সম্মান আল্লাহর।" [সূরা নিসা: ১৩৮, ১
৩৯]

মুনাফিকদের মূর্খতা ও মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করা:
মুনাফিকরা নিজেরা মূর্খ এ জিনিষটি তাদের চোখে ধরা পড়তো না। কিন্তু তারা মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করত। এ কারণেই তাদের যখন মুমিনদের ন্যায় ঈমান আনার জন্য বলা হত, তখন তারা বলত, মুমিনরা-তো বুঝে না, তারা মূর্খ, তাই তারা ঈমান এনেছে। আমরাতো মূর্খ নই, আমরা শিক্ষিত আমরা কেন ঈমান আনব? আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়ে বলেন, "আর যখন তাদে
রকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না।" [সূরা বাকারা: ১৩]

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, যারা কুরআন ও হাদিসের আনুগত্য করে তারা তাদের নিকট নির্বোধ, বোকা। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বলতে কিছুই নাই। আর যারা ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চায় তারা তাদের নিকট সেই গাধার মত যে বোঝা বহন করে। তার কিতাব বা ব্যবসায়ীর মালামাল দ্বারা তার কোন লাভ হয় না। সে নিজে কোন প্রকার উপকার লাভ করতে পারে না। আর যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং তার আদেশের আনুগত্য করে তারা হল, তাদের নিকট নির্বোধ, মূর্খ। তাই তারা তাদের মজলিশে তার উপস্থিতিকে অপছন্দ করত ও তার দ্বারা তারা তাদের অযাত্রা হতো বলে বিশ্বাস করত। [মাদারেজুস সালেহীন ১/৩৫০] 

মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করা হতে বিরত রাখা: 
মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর রাখে খরচ করাকে অনর্থক মনে করে। তাই তারা মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করতে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "তারাই বলে, যারা আল্লাহর রাসূলের কাছে আছে তোমরা তাদের জন্য খরচ করো না, যতক্ষণ না তারা সরে যায়। আর আসমানসমূহ ও যমিনের ধনভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না।" [সূরা আল মুনাফিকুন: ৭]
মুনাফিকরা সব সময় এ আশংকা করত যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে যা আছে, তা মুমিনদের নিকট একটি সূরা নাযিল করে জানিয়ে দিবেন। তাদের এ আশংকার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন।কারো মতে, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলের উপর এ আয়াত নাযিল করেন, কারণ, মুনাফিকরা যখন রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কোন দোষ বর্ণনা, তার বা মুসলিমদের কোন কর্মের সমালোচনা করত, তখন তারা নিজেরা বলাবলি করত, আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় প্রকাশ করে না দেয়। তাদের কথার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন, আপনি তাদের ধমক ও হুমকি দিয়ে বলুন, [‘তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ’]

জিহাদকে অপছন্দ করা ও জিহাদ হতে বিরত থাকা: 
মুনাফিকরা জিহাদকে অপছন্দ করে। তারা কখনোই আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে চায় না। এ কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে জিহাদ হতে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, পেছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর রাসূলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে খুশি হল, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। বল, ‘জাহান্নামের আগুন অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝত’। [সূরা তওবা: ৮১]

মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, "মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলি জানিয়ে দেবে। বল, ‘তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ ।" [তওবা: ৬৪]

তারা যা করেনি তার উপর তাদের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করত: 
মুনাফিকরা যে কাজ করে না তার উপর তাদের কোন ভৎসনা মানতে রাজি না। এমনটি তারা কাজ না করে সে কাজের প্রশংসা শুনতে চায়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবান্তর চাহিদার নিন্দা করে বলেন, যারা তাদের কৃতকর্মের প্রতি খুশী হয় এবং যা তারা করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে পছন্দ করে, তুমি তাদেরকে আযাব থেকে মুক্ত মনে করো না। আর তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। [সূরা আল-ইমরান: ১৮৮]

অপমান ও অপদস্থের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া: 
মুনাফিকরা যুদ্ধ হতে বিরত থাকার জন্য অপমানিত হবে তবুও তারা যুদ্ধে যাবে না। তাদের নিকট মান-সম্মান ও ইজ্জতের কোন দাম নাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা বলছিল, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যখন তাদের একদল বলেছিল, ‘হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তাই তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল নবীর কাছে অনুমতি চেয়ে বলছিল, আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত, অথচ সেগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। [সূরা আহযাব: ১২, ১৩]